আমরা হেঁটে চলেছি । আমরা বলছি কারণ আমার সাথে আরো কয়েকজনকে দেখতে পাচ্ছি। আমরা সবাই এক লাইন ধরে পর পর যাচ্ছি, ঠিক ছোটো বেলায় যেভাবে স্কুলে ড্রিল করতাম। একটু অবাক হলাম, আমাদের প্রত্যেকের পায়ে শেকল পরানো। তাইতো, সেই জন্যইতো হাঁটতে এত কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পায়ে শেকল পরানো কেন? আর আমরা কোথায় চলেছি? আর আমার সাথে এরাই বা কারা। আমার সামনের লোককে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই আমরা কোথায় যাচ্ছি?” লোকটি নির্বিকার। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম “ভাই, আমাদের পায়ে শেকল পরানো কেন?”, লোকটি এবারো কোন উত্তর দিল না। খালি ঘাড়টি ঘুরিয়ে আমার দিকে একবার তাকালো। নির্বিকার দৃষ্টি, মলিন মুখ, তাতে কোন অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। আমি আশে পাশে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম যদিও খুব অন্ধকার। কোনো একটা আলোর উৎস থেকে মৃদ্যু আলো আসছে, কিন্ত তাতে ঠিক অন্ধকার দূর হচ্ছে নাা। বরং অন্ধকার আরো ঘোলাটে হয়ে উঠছে। আমি লক্ষ্য করলাম আমরা মরুভূমির উপর দিয়ে হাঁটছি। আমাদের খালি পা রাতের হিম শীতল বালিতে জমে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। ভারি অবাক হলাম। আমি কিছুই মনে করতে পারচ্ছি না। কিন্তু কেন? জানি না। মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে। সেই সাথে গলাও শুকিয়ে গিয়েছে। শরীর ঘেমে জবজব করছে। রাতের মরুভুমি অত্যন্ত শীতল হয়। উপর থেকে ঘেমে যাওয়ার ফলে শরীর থেকে উত্তাপ অতি দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে। ভয় হল হাইপোথারমিয়া না হয়ে যায়। চট করে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল- আরে! হাইপোথারমিয়া কি জিনিস? এই শব্দটা আমার মাথায় কেন এল? তাহলে কি আস্তে আস্তে আমার স্মৃতি ফিরে আসতে শুরু করেছে? হঠাৎ লাইনের সামনে থাকা লোকটি পিছনে ঘুরে অনেকটা চিৎকার করে বলে উঠল, “আপনারা সর্বশেষ কি করছিলেন মনে করার চেষ্টা করুা করুন। আপনাদের সর্বশেষ স্মৃতি কী একটু মনে করার চেষ্টা করুন।“ ভারী অবাক হলাম। লোকটির সব কথা আমি বু্ঝতে পারলাম। কিন্তু সে ঠিক কোন ভাষায় কথা বলল বুঝতে পারলাম না। এটা যে আমার মুখের ভাষা না, তা আমি নিশ্চিত। আরো অবাক হলাম, তাহলে আমার মাতৃভাষা কী? নাহ, মনে করতে পারছি না। কিন্তু লোকটি ঠিক আমার মাতৃভাষায় কথা বলেনি। কিন্তু আমি তার সব কথা বুঝলাম কী করে? লোকটি দেখতেও ঠিক আমার মত নয়। দেখলাম সে আমার থেকে বেশ লম্বা। ফ্যাটফেটে ফর্সা গায়ের রং, এক মাথা ঘন এলোমেলো সোনালি চুল, আর গভীর নীল চোখের মণি। হঠাৎ করে লোকটি আমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল! একদম বাতাসে মিশে গেল। তার পায়ের বেড়ি ঠাণ্ডা মরু বালির মধ্যে এলিয়ে পড়ে আছে। এ কী ধরেণের ভোজবাজি বুঝতে পারলাম না! আমাদের দলটির মধ্যে মৃদ্যযু সোরগোল উঠলো। এ ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হকচকিয়ে গেছে। আমার সামনের লোকটি এখন নিজেকে ধাতস্ত করে মুখ খুলল, “ভাই, আপনার নাম কী?” “আমার নাম, , , আমার নাম, , , মনে করতে পারছি না।“, একটু থেমে জিজ্ঞেস করলাম,”ভাই আপনার নাম কী?” সে সাফল্যের হাসি হেসে বলল, “আরুশ আরনাভ” , “আরুশ আরনাভ” নামটি সে দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করল। এবং প্রায় উন্মাদের মত আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, “আরুশ আরনাভ”, “আরুশ আরনাভ” আমার নাম “আরুশ আরনাভ”, আমি শ্রীলঙ্কান, আমি শ্রীলঙ্কান। আমি কোটে তে থাকি। মনে পড়েছে, সব মনে পড়েছে।“ হঠাৎ সে চুপ হয়ে গেল। এর পর বলল, “কিন্তু আমি এখানে কীভাবে এলাম? এই সময় তো আমার ক্লাসে থাকার কথাা ছিল!” এরপর সে আমার দিকে তাকিয়ে তার হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, আমি তার হাতটা ধরলাম। তার হাত ঠাণ্ডা, আমার হাতও ঠাণ্ডা। এতক্ষণ পর এই মৃত প্রেত পুরীতে, তার ঐ শীতল আড়ষ্ট হাতের স্পর্শে আমি যেন চিরচেনা বস্তুজগতের মৃদু প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পেলাম! তার ঐ শীতল হাতের মৃদু উষ্ণতা আমার হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে গেল। সে ফিস ফিস করে আমাকে বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি, , ,” তার কথাটি অসম্পূর্ণই রয়ে গেল। হঠাৎ টের পেলাম তার শরীর স্বাভাবিক থেকে অনেক উত্তপ্ত হয়ে গেছে। আমি তার হাতটি ছেড়ে দেবো কিনা ভাবছি, ঠিক সে সময়, সেও প্রথম লোকটার মত আমার হাতে হাত রেখেই অদৃশ্য হয়ে গেল। সে অদৃশ্য হওয়ার আগে দেখলাম তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হাঁ হয়ে গেলাম! আমার হাতে তখনও সেই উষ্ণতা লেগে রইল।
এর পর খানিক সময় কেটে গেল। কেউ কোন কথা বলতে পারল না। একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি হল মাত্র। এরপর সামনে থেকে একজন আফ্রিকান, ভারি গলায় বলে উঠল, “আমাদের আগানো উচিত।“ আমরা সবাই আবার আগের মত হাঁটা শুরু করলাম। আমার সামনের ছেলেটা আরুশ যার নাাম, ও অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ফলে তার পায়ের শেকলগুলো এখন আমার পায়ে জড়িয়ে যেতে লাগলো। হাঁটতে ভারি অসুবিধা হচ্ছে। আমি বাড়তি শেকল আমার হাতে পেঁচিয়ে নিলাম। শেকলগুলো প্রচুর ভারি। আকারে খুব বেশি পুরু নয়, তবুও এত ওজন কেন বুঝলাম না। ওগুলো লোহা কিংবা ইস্পাত দিয়ে তৈরি তাতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে মনে হচ্ছে না জানি কোন নরকের আগুনে পুড়ে পুড়ে ওগুলোতে কালশিটে পড়ে গেছে। এমনকি তা থেকে পোড়া লোহার কটু গন্ধও পাচ্ছি। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। হাতে শেকল নিয়ে হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই হাত দুটো অবশ হয়ে গেল। সেই সাথে এখন পায়ের নিচে পড়তে লাগল ছোট ছোট নুড়ি পাথর। মনে হয় কোনো পাথুরে এলাকায় চলে এসেছি। কিছুক্ষন পরে ধারনাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমরা একটা পাহাড় শ্রেণীর পাদদেশে চলে এসেছি। দুরে, এক মাইলও হতে পারে অথবা কম বেশিও হতে পারে, মরুভূমি ভেদ করে পুরু দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ছোট বড়ো পাহাড়। আমরা যতই ঐ পাহাড় শ্রেনীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম, পায়ের তলে ততো বেশি নুড়ি পাথর পড়তে লাগল। খেয়াল করলাম আমার খালি পা দিয়ে রক্ত পড়ছে। আমি ধপ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জানি না ঠিক কতখন ধরে আমার পা দিয়ে রক্ত পড়ছে, তবে পেছনে তাকিয়ে দেখি ফেলে আসা মরুপথের অনেকটা অংশের বালি রক্তে ভিজে আছে। বুকটা হতাশাই ভরে গেল। ক্লান্তি আর অবসাদে শরীর ও মন ভেঙ্গে পড়ল। আমার সামনের জন মনে হয় আমার মনের অবস্থা টের পেয়ে বলল, “দেখ আমার পাও কেটে চৌচির হয়ে গেছে। কিছু করার নেই, আমাদের সামনে এগিয়ে যেতেই হবে। আবহাওয়া ভাল ঠেকছে না। মনে হয় ঝড় আসবে। অতঃপর সবাই আবার হাটা শুরু করলাম। আমাদের পায়ের সেঁকলে সেঁকলে বাড়ি লেগে ঝন ঝন শব্দ হতে লাগল। মনে হচ্ছে আমারা অনন্তকাল ধরে এই নির্জন মরুপ্রান্তরের পাথুরে জমিনের উপর দিয়ে হাটচ্ছি। যার না আছে শুরু, না আছে শেষ। না জানি কোন বাঁশির নাদ শুনে পনুরুত্থিত আত্মার মত আমরা শুধু হেটেই চলেছি। আমরা এখন সেই পাহাড় শ্রেণির বেশ খানিকটা কাছে চলে এসেছি। কিছুখন পর দেখলাম ছেলেটার কথাই ঠিক। নিয়তির চরম পরিহাসের চুড়ান্ত করে ঝড় উঠল! মরু ঝড়! সবাই একযোগে চিৎকার করে উঠল, “ঝড়! ঝড়! পালাও! পালাও!” সবাই ছুটতে থাকলাম ঐ পাহাড় শ্রেণীর দিকে লক্ষ্য করে। এখন আর কেউ সুসংগোঠিত লাইন করে নয় বরং আড়াআড়ি করে একযোগে যে যেভাবে পারলাম ছুট লাগালাম। কেউ বেশি দূর এগোতে পারলাম না। একজনের সাথে আরেক জনের সেঁকল পায়ে জড়িয়ে সবাই একে অপরের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। পাথুরে জমিনে মাথা ঠুকে কারো মাথা ফেটে গেল। কারো পা বেকাইদায় পড়ে মোচকে কিংবা ভেঙ্গে গেল। আমি বুঝতে পারছি না আমার ঠিক কি হল, তবে আমার ডান হাতে কোন সাড় পাচ্ছি না। তবে এইসব দেখার সময় রইল না। মুহূর্তের মধ্যেই আমারা ঢেকে গেলাম এক সমুদ্র ধুলা আর বালিতে। চোখ মুখ কান নাক দিয়ে তখন ঢুকতে শুরু করেছে ধুলা-বালি। আমার শুকিয়ে যাওয়া খট খটে জিহ্বাতে বালির তিতা নোনা কুৎসিত স্বাদ পেলাম। ততখনে আমরা আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। কাউকে বলে দিতে হলনা, কিন্ত আমরা জীবন রক্ষার তাগিদে সবাই আগের মত এক লাইন করে প্রাণপণ দৌড়াতে শুরু করলাম। আমাদের দলে একজন মনে হয় মাথা ফেটে মারা গেছে। কারন তার অসাড় দেহ এখন আমাদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। কোন অনুভূতি কাজ করচ্ছে না। কোথাও ব্যাথা লেগেছে বলে মনে পড়চ্ছে না। চোখে মুখে বালি ঢুকে মনে হয় অন্ধ হয়ে গেছি। কানে শুধু বাজচ্ছে ঝড়ের ধ্বংস লীলার শোঁ শোঁ শব্দ। ঠিক কত খন হাচড়ে পাছড়ে দৌড়েছি বলতে পারব না। আমি কি অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিলাম ঠিক তাও জানি না। তবে এখন খেয়াল করলাম আমরা জনাকয়েক একটা পাহাড়ের কোন গুহা মত একটি জায়গায় আশ্রয় পেয়েছি। সবাই মৃতপ্রায়, বিধ্বস্ত, সন্ত্রস্ত। আর অন্ধকার। এ অন্ধকারের সাথে কেবল মনে হয় কবরের অন্ধকারেরই তুলনা করা সম্ভব। নাকি আমি কাব্য করছি! মৃদ্যু হাশি পেয়ে গেল। আমার করুন দশায় আমি নিজেই কৌতুক বোধ করছি। নাকি আমি পাগল হয়ে গেছি? আমার আসে পাশে কেউ ব্যাথায় কাতরাচ্ছে, কেউবা মড়ার মত পড়ে আছে, নাকি মারা গেছে তাও জানি না। বাইরে চলচ্ছে সমানে তান্ডব লীলা। আমি এর আগে কখনো মরুভুমি সচক্ষে দেখিনি। মরুঝড় তো প্রশ্নই আসে না। তবুও আমি বলতে পারব এ মনে হয় স্মরণ কালের শ্রেষ্ঠ ঝড়! বাইরে মনে হয় কতিপয় দৈত্য দানবরা যুদ্ধ করছে। গুহার ভেতর থেকেই টের পাচ্ছি বাইরে বিশাল বড় বড় পাথর আঁচড়ে পড়ছে। সে আঁচড়ে পড়া পাথর ভাঙ্গার শব্দ যে কখনো শোনেনি, তাকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। খেয়াল করিনি আমরা কখন সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে একটা রক্তমাংসের কুন্ডুলি পাকিয়ে ফেলেছি। অবাক হলাম! মানুষ যখন অত্যন্ত আতঙ্কে পড়ে, বেঁচে থাকার কৌশল আপনা থেকেই রপ্ত হয়ে যায়- তাকে শিখিয়ে দিতে হয়না কিভাবে বেঁচে থাকতে হবে। এ শিক্ষা আদিম কাল থেকে বংশানুক্রমিক ভাবে তার প্রতিটি কোষের প্রতিটি জিনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। আমারা প্রত্যেকে প্রত্যেকের হিম শীতল শরীর থেকে ওম নিচ্ছি। যেন প্রত্যেকে মিলে এক শরীর।
ঠিক কত সময় আমরা এভাবে ছিলাম জানি না। তবে এখন ঝড় থেমেছে। বাইরে কোনো শব্দ নেই। শুধু পিন পতন নীরবতা। আমাদের প্রত্যেকের মনের ঝড়ও হয়ত থেমেছে। কারন আমি এখন কিছু টের পাচ্ছি। তা হল গন্ধ! প্রবল গন্ধ! আমাদের শরীর থেকে প্রবাহিত শুঁকিয়ে যাওয়া জমাট বাধা রক্তের গন্ধ, শ্লেষ্মা আর অশ্রুর গন্ধ, মল ও প্রসাবের গন্ধ! এবং সব কিছুকে ছাপিয়ে তীব্র ক্ষুধা। আমার শরীরের সাথে লেপ্টে আছে গত রাতে মারা যাওয়া সম্ভোবত এক কোরিয়ান ভদ্রলোকের মৃত দেহ। পাথরের আঘাতে তার মাথা পুরা থেতলে গেছে। তার মাথা থেকে বেরিয়ে আসা মগজ এখন আমার সমগ্র মুখে লেপ্টে আছে। এই দুর্বিষহ অবস্থায়ও আমার সারা শরীর গুলিয়ে গেল। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করলাম সেই জটলা থেকে নিজেকে মুক্ত করার। কিন্তু পারলাম না। আমাকে চেপে ধরে মড়ার মত পড়ে আছে আরও কিছু শরীর। নাকি তারাও মরে পড়ে আছে! একটা প্রবল আতঙ্কে আমার শরীর জমে গেল। নিজের অজান্তেই শুকনো গলা থেকে বেরিয়ে এল একটা আর্তচিৎকার। নিজের গলা শুনে নিজেই চমকে উঠলাম! মনে হলো কোন ফাঁপা বাঁশের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে ঐ শব্দ। কিন্তু এতে একটা কাজ হলো। আমার পায়ের কাছে কে যেন নড়ে উঠল। সেই আফ্রিকান লোকটা। দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ গড়ণ। সে উঠে বসল। এরপর আমার দিকে তার বড় বড় চোখ তুলে তাকিয়ে থেকে সে বলল, “তোমার নাম রিফাত?” ভারি আশ্চর্য হলাম। ইতস্থ করে বললাম, “জানিনাতো। তুমি কি করে জানলে?” সে খানিকটা আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল,” গতরাতে তুমি বেশ কয়েকবার চিৎকার করে বলেছ, “আমার নাম রিফাত, আমার নাম রিফাত”। আবাক হলাম, আমার কিছুই মনে নেই। তাহলে কি প্রচন্ড অমানুষিক শারিরিক ও মানুষিক চাপে, কিছু খনের জন্য আমার স্মৃতি ফিরে এসেছিল? তাহলে এখন কিভাবে আমি বেমালুম ভুলে গেলাম। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি মনে পড়েছে। ও মৃদ্যু কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, “জানি না”। এরপর ও নিজের পায়ের সেঁকলটা একদিকে সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো, তোমাকে এর ভেতর থেকে বের করি”। এই বলে ওর শক্ত মজবুত পেশিবহুল দুই হাত দিয়ে, অতি সাবধানে একজন একজন করে মানব দেহ সরাতে লাগল। এর মধ্যে আরো জনা কয়েক জেগে উঠেছে। একজন চিৎকার করে উঠল, “আমার পা, আমার পা!” আমি সবিস্ময়ে দেখলাম, লোকটির ডান পা হাটুর কাছ থেকে পুরো থেতলে গেছে। এই দৃশ্য দেখে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল! লোকটি জাতে ককেশীয়ান। সম্ভবত ইউরোপিয়ান। আফ্রিকান লোকটি এবার আমাকে রেখে তার কাঁধ ধরে একধারে বসিয়ে দিল। তার ডান পায়ের সেকলটার এমন ব্যবস্থা করল যাতে আচমকে টান না লাগে। এ দৃশ্যটি তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাকে আরো বাড়িয়ে দিল। এবার ধিরে ধিরে সে আমাকে ঐ জটলা থেকে বের করল। একে একে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া দশটা প্রাণী উঠে বসল। এবার ভাল করে দেখলাম ওদের। এক জন আফ্রিকান, তিনজনকে চাইনিজ বা মঙ্গোলিয়ান বলেই মনে হল। একজনকে জাপানিজ, দুই জন মনে হয় ককেশিয়ান, যার মধ্য একজনের ডান পা ভেঙ্গে গেছে। আর দুই জনকে ঠিক কোন দেশের ঠাউরাতে পারলাম না। ভারতীয়ও হতে পারে, আবার পাকিস্তানি বা বাংলাদেশীও হতে পারে। কিন্তু আমি, আমি কোন দেশি? আমার নিজের চেহারা তো আমি দেখতে পারছি না। কাউকে কি জিজ্ঞেস করব? এই দুঃসময় কি এই ধরনের প্রশ্ন করা যায়? চাইনিজ লোকটি বলল, “খুব তৃষ্ণা পেয়েছে আর খুব খুদাও লেগেছে।“ অন্য চাইনিজ লোকটি বলল আমাদের সবার একই অবস্থা, সে সেঁকলের একেবারে প্রথম প্রান্তে ছিল, তার পরেই ছিল ভারতীয় লোকটি, তারপর আরেকজন চাইনিজ, তারপর আফ্রিকান লোকটি, আর সবার শেষ প্রান্তে ছিল একজন ককেসিয়ান ধরনের লোক, তবে উনার মুখের গঠনে অনেকটা এশিয় ভাব আছে, লোকটি কি তাহলে তুরস্কের? নাকি সেন্ট্রাল এশিয়ার ঠিক বুঝতে পারলাম না, যাইহোক তার সামনে ছিলাম আমি, সর্বশেষ থেকে দ্বিতীয় জন। আর আমাদের প্রত্যেকের দুই পা পরযায়ক্রমিক ভাবে লোহার সেঁকল দিয়ে বাঁধা। যেন একদল নরকের ক্রীতদাসকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল নরকে। সেঁকলের প্রথম দিকের ভারতীয় লোকটি বলল আমাদের পায়ে সেকল বাঁধা কেন? আফ্রিকান লোকটি বলল, “পাপ করেছি আমরা, ঘোরতর পাপ। মনে হয় আমাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল”। ককেশিয়ান লোকটি উত্তর দিল, “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বন্ধু, তুমি মনে হয় কথাটি হেয়ালি করে বলেছ।“ আফ্রিকান আবার বলল, “তাহলে আমাদের পায়ে সেঁকল কেন? আর আমদের কোথা থেকেই বা একত্রিত করা হয়েছে, কারন আমি কোথায় ছিলাম বা কি করছিলাম, কিছুই মনে করতে পারচ্ছি না”. সবাই খানিক খন চুপ থাকল। তারপর আমার সামনের ভারতীয় ছেলেটি বলল, “দ্বীপা”। তার সামনের জাপানিজ লোকটি বলল, “দ্বীপা কি?” ভারতীয় ছেলেটি বলল, “দ্বীপা কি না কে, ও আমার স্ত্রী। আমরা দুইজন পার্ক স্ট্রিট দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম, তারপর, , ,।“ জাপানিজ লোকটি বলল, “তারপর কি হল”। “তারপর, আর মনে নেই। কিছই মনে করতে পারচ্ছি না! আহ! আমার খুব মাথা ব্যাথা করছে।“ আমি এবার যোগ দিলাম, “পার্ক স্ট্রিট জায়গাটা কলকাতায় না?” সে বলল, “ হ্যা”। আপনি কি করে জানলেন দাদা? আপনিও কি কলকাতার?” আমি বললাম, নাহ, আমি কলকাতার না। তবে আমার মনে হয় আমি ওখানে গিয়েছি। জায়গাটা আমার কাছে পরিচিত মনে হল। “লোকটি বলল,” তাহলে আপনি কোথাকার? আপনার পরিচয় কি?” আমি বললাম, “তাইত মনে করতে পারচ্ছি না।“ নিজের উপরই রাগ হতে লাগল। আমি একটা সুযোগ পেলাম, ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতে যাব আমি দেখতে কেমন ঠিক সেসময় আফ্রিকান লোকটি ভারতীয় ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি তোমার বৌয়ের নাম মনে করতে পেরেছে, তোমার নিজের নাম কি মনে পড়ছে?” ছেলেটি বলল, “না, সেটাইতো মনে করতে পারছিনা।“ এ কথা শুনে আমাদের মধ্যে একটা হাসি হাসি ভাব চলে এল। ছেলেটি একটু লজ্জা পেয়ে সলজ্জ হাসি হাসল। এই বার প্রথম চাইনিজ লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটু বাইরে গিয়ে দেখি খাবার কিছু পাওয়া যায় কি না। এই বলে সে গুহাটির বাইরে গেল। সেঁকলে টান পড়ায় বিরক্ত হয়ে অপর ভারতীয় লোকটিও তার পিছনে পিছনে গেল। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম। কারন সবার পা’ই সেকলে বাঁধা। তবে ঐ ইউরোপিয়ান লোকটি যার একটি পা ভেঙ্গে গিয়েছে সে নিরুপায় টান টান সেঁকল দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে থাকল। আমার পেছনের লোকটি আমাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে আমাদের সেঁকলে একটা হ্যাচকা টান খেলাম, আর সেই সাথে একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল। একটু পর দেখলাম কার যেন কাটা মাথা ছিটকে মাটিতে পড়ে দরজার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ফুটবলের মত গড়িয়ে গেল। সেই সাথে মেঘের মত একটা গর্জনে আমাদের কানের তালা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। সাথে সাথে ঐ ভারতীয় ও চাইনিজ লোক দুইজন ধরমড় করে গুহার ভেতর হুমড়ি খেয়ে ঢুকে পড়ল এবং গুহার মুখ সংলগ্ন দেয়ালে নিজেদের পিঠ সেঁটে দিয়ে ভয়ার্ত ভাবে কাঁপতে থাকল। আফ্রিকান লোকটি ছুটে যেতে গেল বাইরে, অন্য চাইনিজ লোকটি তার হাত চেপে ধরল। ইশারারায় বুঝিয়ে দিল বাইরে না যেতে। বাইরের চাইনিজ লোকটির কি হয়েছে তা আর বুঝতে বাকি থাকল না। শুনতে পেলাম, মানুষের হাড় ভাঙ্গলে যেমন মট মট শব্দ হয় তেমন শব্দ। আর কারো শরীর থেকে মাংস খুবলে ছিঁড়ে নিলে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দ। আর ক্রমাগত সেঁকলে টান পেতে থাকলাম বাইরে থেকে। যেন আমাদেরকে কেউ সেঁকল ধরে টান দিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে চায়। আমরা সবাই আবার জড়সড় হয়ে গেলাম যাতে বাইরে থেকে টানটা শামলে উঠতে পারি। খালি আমাদের আফ্রিকান বন্ধু মাটি থেকে একটা বিরাট পাথর ঘাড়ের উপর তুলে ধরে থাকল। যাতে যেই প্রানীই হক, ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলে তার মাথায় মেরে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু বাইরে থেকে কোন প্রানীই ভিতরে ঢুকলো না। বরং হ্যাচকা টান আরো বাড়তেই থাকল। আমরা ভেতরে সবাই সেঁকল টান টান করে ধরে রেখেছি যাতে কেউ ছিটকে পড়ে বাইরে বেরিয়ে না যায়। হঠাৎ করেই সেঁকলের টান বন্ধ হয়ে গেল এবং আমরা সবাই একে অপরের গায়ের উপর ছিটকে পোড়লাম। এবার আফ্রিকান লোকটি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করল, পারল না। সেঁকলে টান পড়েছে। সামনের ভারতীয় লোকটা তখন বাইরে থেকে সেকলটা ভেতরে টেনে আনল। খালি সেঁকল, বাম দিকের বেড়িতে কেবল একটা কাটা পা ঝুলছে, চাইনিজ লোকটির পুরা শরীরটাই নিয়ে গেছে ঐ অজানা জন্তুটি। সবাই সবিস্ময়ে আর্ত চিৎকার করে উঠলাম। আফ্রিকান লোকটি সামনের ভারতীয়কে জিজ্ঞেস করল, “কি ছিল ওটা”। লোকটি অত্যন্ত ভয় পেয়েছে। খুব দ্রুত নিঃশ্বাস নিচ্ছে; সে বমি করার জন্য উদ্যত হলো কিন্তু পেট খালি থাকাই শুধু উয়াক উয়াক শব্দ হল, কিছুই বের হল না। নিজেকে সামলিয়ে উঠে সে বলল, “জানি না, আমরা ঐ গতকাল মরুভুমির ভেতর দিয়েই হাটার সময় আমার মনে হচ্ছিল, আমাদের আস পাশ দিয়ে কিছু একটা আমাদেরকে ফলো করছে। কিন্তু কিছু দেখতে পাইনি, , ,” আফ্রিকান লোকটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আহ, বাইরে কি ছিল, সিংহ না অন্য কিছু”? লোকটি বলল না ওসব কিছু না। এই জন্তু আমি আমার বাপের জীবনেও দেখি নি। বাঘের মত সাইজ, আরো বড়ও হতে পারে! সারা শরীরে লাল লাল রোয়া উঠেছে যেন। মনে হল ও প্রাণীর সারা শরীরের পশম যেন কেউ খুবলে নিয়েছে। দাতগুলো বাঘের চেয়েও বড়। আর চোখ দুটো, , , আহ! আর বলতে পারবনা, , , , সাক্ষাত জম দূত। অন্য চাইনিজ লোকটি যে ভারতীয় লোকটির পেছনেই সেঁকলে বাঁধা ছিল সেও বাইরে গিয়েছিল। সে বলল, আমি দেখলাম ঐ প্রানীটা কোন একটা পাথরের পেছন থেকে লাফ দিল। মনে হয় ওখানে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। এক লাফ দিয়েই ঐ লোকটির মাথা কামড়ে ধরল। সেঁকলে টান খেয়ে আমরা মাটিতে পড়ে গেলাম। ওইটার হা এতই বড় ছিল যে ঐ লোকটার পুরা মাথাটা তার মুখের মধ্যে চলে গেছে। মুহূর্তেই একটানে লোকটার ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলল। আমরা মাটিতে বসে পড়েছিলাম। তখন প্রাণীটা আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা গর্জন করে উঠল। তারপর ঐ লোকটার শরীর থেকে মাংস খুবলে খেতে লাগল। আমরা দুই জন এই ফাঁকে গুহার ভেতরে ঢুকে পড়লাম।“ এরপর ভারতীয় লোকটি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কৈ কোন চোখত দেখলাম না। চোখের জায়গাই লাল রঙের ফোলা ফোলা কিছু বস্তু দেখেছি, অনেকটা মাছিদের অক্ষিপুঞ্জি যেমন হয়। ওইগুলো আয়নার মত স্বচ্ছ মনে হলো। আমার পিছনের লোকটি এইবার দরজার বাইরে যেতে উদ্যত হলো, বলল, “মনে হয় প্রানীটা এখন চলে গেছে। দেখি বাইরে কি অবস্থা। বলেতেই হয় লোকটার সাহস আছে। সে সামনে এগিয়ে যাওয়াতে আমার পায়ের সেকলেও টান লাগল। আমিও তাই বাধ্য হয়ে এগিয়ে গেলাম। সমস্যা হল আমাকে পেছন ফিরে সামনে যেতে হচ্ছে। তাই সবাই একটু সমন্বয় করে সামনে এগুতে বাধ্য হল। বাইরে এসে দেখা গেল সব কিছু ফাঁকা। কোনো প্রানী নেই। তবে ঐ চাইনিজ লোকটার কাটা মাথা পড়ে আছে একটু দূরে। আমার গা গুলিয়ে এল। ভয়ে সবাই শিহরিত হয়ে উঠলাম। না জানি এই মৃত্যু উপত্যকায় আর কি লুকিয়ে আছে। আমার সামনের ভারতীয় ছেলেটা বলল, আমাদের সামনে এগোনো উচিত। এই জযায়গাই থাকলে ঐ জন্তুটা আবার শিকারের সন্ধানে আসতে পারে।“ ভারতীয় লোকটি বলল, “শোনো আমরা যেখানেই যাইনা কেন ঐ জন্তুটা আমাদের পেছন পেছন আসবে, আমাদের ফলো করবে, আর সুযোগ পেলেই আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে।“ আফ্রিকান লোকটি বলল, কিন্তু আমরা এখানে বসে থেকে তো মৃত্যুর অপেক্ষা করতে পারিনা। আমাদেরকে সামনে আগাতেই হবে।“ আমি দেখলাম আমাদের সামনে এলমেলো ভাবে পড়ে আছে ছোটো বড় পাথর, আর তারপর সামনে বিশাল ধূ ধূ মরুভূমি। দৃষ্টির সীমা শেষ হয়ে গেল, কিন্তু মরুভুমি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। ভাবলাম গতকাল কি আমরা এই বিশাল মরু প্রান্তর পার করে এসেছি! আমরা ঠিক কত দিন ধরে হাটছি তাহলে? আমি বললাম, “সামনে তো মরুভুমি ছাড়া আর কিছুই দেখছি না, আমাদেরকে তো সামনে এগোতে হলে এই পাহাড়ে উঠতে হবে। কে যেন বলল, কিন্ত তা কি করে সম্ভব? আমাদের পাতো সেঁকল দিয়ে বাঁধা।“ আমার পেছনের লোকটি বলল, তা মনে হয় করতে হবে না। আমরা যেই গুহায় রাত কাটালাম, এটি মনে হয় একটা গিরি খাত। ভেতরে একটা বড় ফাটল দিয়ে আমি গতকাল বাতাস পেয়েছিলাম। মনে হয় ঐ প্রান্ততটি উন্মুক্ত। আফ্রিকান লোকটি বলল, “তাহলে ঐ দিকটা দিয়েই চেষ্টা করে দেখি।“ সবাই স্মমত হল। ভারতীয় লোকটি বলল, “কিন্ত আমাদের সাথে ত একটা লাস আছে। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব।“ আফ্রিকান লোকটি বলল, হ্যা তাতো ঠিক, কিন্তু তাকে সেঁকল থেকে ছাড়াব কিভাবে।“ সবাই আমরা চিন্তিত হয়ে গেলাম। এই সমস্যার সমাধান কারোরি জানা নেই। আমাদের সাথে এমন কোন আস্ত্রও নেই যে সেঁকল কাঁটা যাবে। তাহলেত আমারা নিজেদেরকেই মুক্ত করতে পারতাম। এমন সময় সেই মঙ্গোলিয়ান লোকটি সামনে এগিয়ে এল। এবং কাউকে কিছু না বলে মাটিতে কি যেন খুজতে লাগল। দেখলাম সে একটা ভারী মোটামুটি সূচালো পাথর হাতে তুলে নিল। মুখ দিয়ে বলল, “ সব কিছুরই সমাধান আছে।“ এর পর বরবরের মত ওই মৃত কোরিয়ান লোকটির পায়ের গোড়ালী বরাবর আঘাত করতে লাগল। আমার মুখ দিয়ে আচমকাই একটা চিৎকার বেরিয়ে গেল, আহ! করে কি করে কি!” কিন্তু সবাই নির্বিকার থাকল। মঙ্গোলীয়ান লোকটি শুধু আবেগহীন ভাবে বলল, এর থেকে কি ভালো কোনো আইডিয়া তোমার জানা আছে?” নেই, তাই চুপ হয়ে গেলাম। দেখলাম লোকটি ঐ মৃত লোকটার পা দুটো একটু একটু করে থেতলে দিচ্ছে। ঝড়ে যে ইউরোপিয়ান ভদ্রলোকের ডান পা’টা ভেঙ্গে গিয়েছিল, দেখলাম সে লম্বা আফ্রিকান লোকটির পেছনে গিয়ে লুকালো। একটু পর, যখন ঐ মৃত লোকটার দুই পাই পিষে ফেলা হয়েছে, তখন ঐ মঙ্গোলিয়ান লোকটি তার পা’দুটোকে মুড়িয়ে সেঁকলের বেড়ির ভেতর থেকে টেনে বের করে আনল। এবং মুখে একটা সাফল্যের হাশি এনে বলল, “সমস্যা সমাধান, এখন ঐ জন্তুটির জন্য আরেকটা খাদ্য প্রস্তুত থাকল। এটাকে খেয়ে পরে আমাদেরকে খেতে আসবে।“ আমরা ঐ লোকটির কথা শুনে হা হয়ে গেলাম। কি বলে লোকটা! তার পাশবিকতা ঐ পশুটাকেও হার মানায়। আমারা এবার নয় জন একেএকে ঐ খাতটার ভেতরে ঢুকলাম। সত্যিই এটা একটা গিরিখাত। পাহাড়ার মাঝখান দিয়ে এই সরু অন্ধকার ফাটল দিয়ে আমরা একে একে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। লক্ষ্য করলাম ঐ ইউরোপিয়ান লোকটা তার ভাঙ্গা পা নিয়ে খুব কষ্ট করে হাটছে। ডান কাধটা পাহাড়ের দেয়ালে ভর দিয়ে ভাল পাটা দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটচ্ছে। বেশ খানিক খন হেটে আমরা পাহাড়ের অপর প্রান্তে পৌছালাম। এতক্ষণ যেন দম বন্ধ হয়ে ছিল। বাইরে এসে দেখলাম অবারিত মুক্ত প্রান্তর, উপরে মেঘশুন্য নীল আকাশ আর অক্সিজেন। মনে হল বেঁচে আছি, এখনও বেঁচে আছি। সামনে থেকে কিছু অসন্তোষের শব্দ শোনা গেল। আমিও সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই। সামনে অনেক দূরে কিছু তৃণভূমি দেখা যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সেখানে পৌছাতে গেলে আগে আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে অন্তত ত্রিশ চল্লিশ ফুট নিচে নামতে হবে এই পাথুরে ঢাল বেয়ে। পাহাড়টি খাড়া বা খুব মসৃণ নয়। অন্য সময় হয়ত আস্তে ধীরে নামা যেত। কিন্তু এখন আমাদের প্রত্যেকের পায়ে সেঁকল বাঁধা আর আমাদের সাথে একজন আছে যার রকটা পা খোড়া। সুতরাং পাহাড় বেয়ে নামতে একটু এদিক সেদিক হলেই সবাই একসাথে গিয়ে পড়বো ত্রিশ চল্লিশ ফুট নিচে । আবার যদি পাহাড় থেকে ভালোভাবে নামতেও পারি তারপর এই বিশাল খালি পাথুরে প্রন্তর পার হতে হবে ঐ তৃণভূমিতে যেতে হলে। এই সব ভাবনা আমাকে নিস্তেজ করে দিল। আফ্রিকান লোকটি তার স্বভাব সুলভ কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, “ওকে গাইজ, বেটার বি আর্লি। মনে হয় আর কয়েক ঘন্টা পরেই সন্ধ্যা নামবে।“ এইবার সে ইউরোপিয়ান খোড়া লকটিকে বলল, শোনো বন্ধু, তুমি সাবধানে আমার কাঁধে ওঠো, আমি তোমাকে আমার কাধে করে নামাবো।“ এবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোনো সবাই খুব কেয়ারফুলি, সবার শেষে যে আছে সে সবার আগে নামবে, তারপর আমার বন্ধু রিফাত, তারপর যার স্ত্রীর নাম দ্বীপা সে নামবে, তারপর পর্যায় ক্রমে একে একে সবাই খুব ধীরে ধীরে সাবধানে নামবে। ওকেই? গড স্পীড গাইজ, গড স্পীড।“ আমরা তাই করলাম। আমরা সবাই নির্বিকার ভাবে একে একে নিচে নামছি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পা রেখে। আমার হাত পা ছড়ে যাচ্ছে। শরীরের সমস্ত ওজন যখন হাতের উপর পড়ছে তখন নিজেকে অনেক ভারী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার হাত বুঝি এখনই ছিড়ে যবে। আর যখন আমার পা কোনো খাঁজে পড়ছে আর আমার সমস্ত শরীরের ভর পায়ের উপর দিচ্ছি বুঝতে পারচ্ছি কাঁটা ছেঁড়া পায়ের পাতায় শরীরের ভার মনে হয় বেশি ক্ষণ রাখতে পারব না। মনে হয়ে এক্ষণই পড়ে যাব ত্রিশ চল্লিশ ফুট নিচে। আবাক হতে হয় এরকম পরিস্থিতিতেও আমাদের আফ্রিকান বন্ধু কিভাবে প্রায় ছয় ফুট লম্বা একজন মানুষকে নিজের কাধে করে নিজের শরীরের ভারকে তুচ্ছ করে পায়ে সেঁকল পরা অবস্থায় অতি সাবধানে এই ত্রিশ চল্লিশ ফুট নিচে নামচ্ছে। সত্যিই শ্রদ্ধাই আমার বুক ভরে গেল। ওর ঐ কৃষ্ণ নিগ্র চামড়ার নিচে যে অনেক শুভ্র মানব দরদী একটা হৃদয় আছে তা বুঝতে পারলাম। ও ওর পিঠে চড়া লোকটিকে বলচ্ছে “কি ব্যাপার তুমি এত নড়চ্ছ কেনো পড়ে যাবে তো।“ লোকটি বলল, “আমার খুব ভয় করছে। এক বার নিচে তাকিয়েছিলাম, তারপর থেকে।“ ও অবাক হয়ে বলল, “নিচে তাকিয়ো না, বুঝতে পারচ্ছি তোমার নার্ভাস লাগচ্ছে। অন্য কিছু নিয়ে ভাব, দ্রুত”। “অন্য কিছু মাথায় আসচ্ছে না”। “অন্য কিছু ভাব। আচ্ছা তোমার নাম কি?” “মনে পড়চ্ছে না”। “ঠিক আছে। তুমি কোথায় থাক?” , “মিলানে, মনে পড়েছে, ইটালির মিলানে”। লোকটা খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল। আফ্রিকান বন্ধুটি দ্রুত তাকে শান্ত করে বলল, “নোড়ো না, প্লিজ নোড়ো না, তাহলে আমরা সবাই পড়ে যাব।“ লোকটি নড়া চড়া বন্ধ করল। সত্যিই যদি এই ঢালটা যদি চল্লিশ ফুট গভীর না হয়ে যদি এক দেরশ ফুট গভীর হত, তাহলে এই সেঁকল পরা অবস্থায় আর নিচে নামা যেত না। কিভাবে আমরা নিচে নামচ্ছি তা কল্পনা করলেও শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। এক জন মানুষ থেকে অন্য মানুষ পর্যন্ত সেঁকলটি দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা। সুতরাং পাহাড় থেকে নামতে খুব ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। একজন এক পা নিচে নামালে তার উপরের জন ঐ জায়গায় তার এক পা নামাচ্ছে। এইসময় উপরের জনের শরীরের অর্ধেক অংশ নিচের জনের সম্মুখ ভাগে লাগচ্ছে। তাই নিচের জনকে অতি সাবধানে তার মাথা সহ অর্ধেক শরীরটা পাহাড় থেকে দূরে হাতের ভরসায় সরিয়ে নিতে হচ্ছে যতক্ষন না সে তার পা নিচের কোন খাঁজে নামিয়ে দিতে পারছে। প্রচন্ড রিস্ক নিয়ে নিচে নামচ্ছি আমরা। নিচে নামতে নামতে আমার পেছনের লোকটা হঠাৎ থেমে গেল। কি হয়েছে নিচে তাকাতেই দেখলাম ও গোটা কয়েক ডিম পেয়েছে। পাখির ডিম। সে খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, “ডিম পেয়েছি, হা ঈশ্বর ধন্যবাদ, এগুলা এখন আমরা খেতে পারব। ডিমগুলো দেখলাম সে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিল। তারপর আমরা আবার নামতে শুরু করলাম। এর বেশ কিছক্ষণ পর আমার পেছনের লোকটি প্রথমে মাটিতে পার রাখল। তারপর অন্য পাটিও নিচে রাখল। খুশিতে সে আত্মহারা! আমরাও প্রচণ্ড খুশিতে আত্মহারা। প্রায় লাফিয়ে ওঠার মত অবস্থা। ঠিক সে সময় ঘটল বিপত্তি। আমাদের সবার উপরে যে ভারতীয় লকোটি ছিল, সে তখনো বেশ উপরে ছিল। হঠাৎ তার হাত ছুটে গেল! সে প্রবল বেগে নিচে পড়ে গেল। তার পেছনের চাইনিজ লোকটিও তাল সামলাতে না পেরে তার সাথে পড়ে গেল। তার নিচে ছিল আফ্রিকান লোকটি সে খ্রিপ্য গতিতে ঐ দুইজনের মধ্যবর্তী একটা সেঁকল বাহাত দিয়ে ধরে ফেলল। কিন্তু তার পিঠে থাকা এক পা খোড়া লোকটা বড় ঝাকুনি খাওয়ার দরুন তার হাত ঘাড় থেকে ছেড়ে দিল। আর দেখতে হল না। ঘটনা টি এত দ্রুত ঘটে গেল যে কোনো কিছু ভাবার অবকাশ পেলাম না। শুধু উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, আমার আফ্রিকান বন্ধু এক হাতে সেঁকল ধরে আছে, যে সেঁকল পায়ে ভারতীয় ও চাইনিজ লোকটি ঝুলচ্ছে, আর তার অন্য হাত দিয়ে প্রান পনে আঁকড়ে ধরে আছে পাহাড়ের একটা খাজ। এইদিকে তার পিঠের ইটালিয়ান লোকটি উল্টো হয়ে ঝুলচ্ছে মঙ্গোলিয়ান লোকটির ঠিক পিঠের উপর। সে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছি, আর যাই হোক যেন আমার আফ্রিকান বন্ধুটির হাত না ছোটে। ঠিক সে সময় তার হাত ছুটে গেল। দেখতে দেখতে সবাই একে একে পিছলে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেলাম। প্রায় বিশ ফুট ঊচ্চতা ছিল। আমরা তখন সবাই পাথুরে মাটির উপর গরা গড়ি খাচ্ছি। আমি অনেক জোরে মুখে একটা বাড়ি খেয়েছি কিছুর সাথে। মুখে কোন সাড় পাচ্ছি না। দেখলাম জাপানিজ লোকটার একটা হাত ভেঙ্গে গিয়ে হাড় বের হয়ে গেছে সেদিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। হঠাৎ মঙ্গোলিয়ান লোকটি উঠে সবার উপরে থাকা ঐ ভারতীয়কে চেপে ধরল। কেউ ঠ্যাকানোর আগেই দেখলাম তার মুখে ও একটা ঘুশি মেরে বসেছে, লোকটি তখন চিৎকার করে বলল, “আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না। আমার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে গাছে।“ আমি তাড়া তাড়ি ছুটে গেলাম তাকে ঠ্যাকাতে। লোকটা তখন ঐ ভারতীয়র বুকের উপর চেপে বসেছে। আমি যেয়ে পেছন থেকে তার দুই কাঁধ খামচে ধরলাম। লাভ হল না। তার বিশাল হাতের কুনুই দিয়ে ততক্ষনে সে আমার নাকে আঘাত করেছে। আমি কিছু টের পেলাম না যেন। খালি দেখলাম আমি পেছনে ছিটকে পড়েছি। আর দেখলাম আমার নাক থেকে রক্ত পড়ছে আমার হাতে। আমি হাতটা দিয়ে আমার নাক চেপে ধরতেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। ঠিক জানি না কতখন পরে জ্ঞাণ ফিরেছে, দেখলাম আমকে একটা পাথরের উপর ঠেস দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। দেখলাম আমার আসে পাসে সবাই গোল হয়ে বসেছে। নাকটা এখনো ব্যাথা করছে তবে রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। আফ্রিকান লোকটি আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, “এখন কেমন লাগচ্ছে, এই নাও একটা ডিম খাও।“ আমার পেছনের ককেশিয়ান লোকটি বলল, “নয়টা ডিম ছিল। তিনটা ডিম ভেঙ্গে গেছে, বাকি ডিম আমরা ভাগ করে খেয়েছি।“ আফ্রিকান লোকটির কাছ থেকে ডিমটি নিলাম, দেখলাম ছিদ্র করা, অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা আমার জন্য রেখে দেয়া হয়েছে। ডিমটা এক চুমুকেই খেয়ে ফেললাম। এরপর দেখলাম ভারতীয় লোকটি শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। তার দুটো হাত চেপে ধরে রেখেছে তার শরীরের বাম পাশটা। বুঝলাম, তার বাম দিকের পাঁজর ভেঙ্গেছে। লক্ষ্য করলাম চাইনিজ লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম,” হাই“। সে উত্তর দিল, “হ্যালো, আমার নাম লিয়্যাং ক্যাং”। আমি বললাম, “বাহ! তোমার মনে পড়েছে। গুড। তোমার বাড়ী কোথায় তা মনে পড়েছে”? “হ্যা, আমার বাড়ি উহানে।“ আমি বললাম, “কোথায়?” সে আবার বলল, “উহান, চাইনার হুবেই প্রদেশে অবস্থিত।“ আমি বললাম, “বাহ, এবার তাহলে তুমিও অদৃশ্য হয়ে যেতে পারবে।“ ও তখন জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, অদৃশ্য হয়ে মানুষ কোথায় যায়?” আমি বললাম, “তাতো জানি না।“ আফ্রিকান লোকটি এখন আমাদের সাথে যোগ দিল, “আমার মনে হয় যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে যায়।“ আমি বললাম, মানে নিজের দেশে বা বাড়িতে ফিরে যায়।“ সে হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো। তখন শুয়ে থাকা ভারতীয় লোকটি বেশ কষ্ট করে একটা পাথর ধরে উঠে বসল, তারপর বলল, “আমাদের দলের সবার সামনে ছিল একজন সাদা মানুষ। তাকে বলতে শুনেছি যে তার নাকি স্মৃতি ফিরে এসেছে। আর সে নাকি নিজের সম্পর্কে সব কিছু মনে করতে পেরেছে। সে নাকি একজন নিউজিল্যান্ডের বাসিন্দা। তার অফিস থেকে সে নাকি তার প্রাইভেট-কারে করে বাসায় ফিরছিল। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, আর তার নাকি ঘুমঘুমও পাচ্ছিল। হঠাত সে নাকি অ্যাকসিডেন্ট করে বসে। তার সর্বশেষ স্মৃতি নাকি ওইটাই।“ আফ্রিকান লোকটি এখন বলে উঠল, “দেখছ, মনে হয় আমার কথাই ঠিক। আমার মনে হয় আমরা সবাই মারা গিয়েছি আর এখন আফটার লাইফে আছি।“ আমি তখন বললাম, “তাহলে এখনো আমাদের ব্যাথার অনুভুতি আছে কেন? আরে এই ভারতীয় ভাইটির পড়ে যেয়ে বুকের পাজরও ভেঙ্গেছে। আর ঐ ইতালিয়ান ভদ্রলোকটির গতকাল পাও ভেঙ্গে গেছে। আমারা মারা গেলে নিশ্চই আমাদের সাথে এগুলো হত না। তাই না।“ এর উত্তর আফ্রিকান লোকটির কাছে নেই। সে চুপ করে থাকল। একটু পরেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে গেল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আজকের রাতটা আমরা এখানেই কাটিয়ে দেব। কাল ভোরে আলো ফুটলে আবার হাটা শুরু করব। আজকের রাতটা বিশ্রাম নেয়াই ভালো। আমরা সবাই পাশাপাশি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। শুধু আমার পিছনের ককেশিয়ান লোকটি জেগে রোইল পাহারা দেয়ার জন্য। কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানি না, ঘুম ভেঙ্গে গেল কিছু বিচিত্র হাশির শব্দ শুনে। এই বিচিত্র খোলা প্রান্তরে অকারনে মানুষের হাশির শব্দ শুনলে গা ছমছম করে ওঠে। আমার বুকের মধ্যে ধপ করে উঠল। চোখ বন্ধ করে রইলাম। অশরীরী বা যাই সামনে থাকুক আমি দেখতে চাইনা। এবার কার যেন চিৎকার শুনতে পেলাম। আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারলাম না। তাকিয়ে দেখি। চিৎকারটি দিয়েছেন জনৈক ইটালিয়ান ভদ্রলোক। কারণ, তার ভাঙ্গা পা’টি ধরে টানা হ্যাচড়া করছে একটা হায়ানার দল। তার ঐ পা’টি কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে প্রানীগুলো। আমাদের দলের আরো কয়েক জন উঠেছে। আমি আমার কাছে পড়ে থাকা কিছু নুড়ি পাথর তুলে নিলাম আর ওদের দিকে ছুড়তে লাগলাম। আর চিৎকার করতে থাকলাম। এতক্ষনে বাকি সবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সবাই এখন জোরে চেচাতে লাগল, আর যে যেভাবে পারে হায়ানাগুলোর দিকে পাথর ছুড়তে লাগল। হায়ানাগুলো এবার ভয় পেয়ে ছুটে পালাল। ভোর হয়ে গেল। আমারা আর কেউ ঘুমাতে পারলাম না। খুব সকালে আমরা আবার হাটতে শুরু করলাম। দুপর পর্যন্ত আমরা হাঁটলাম। যদিও মরুভূমি পার করে এসেছি কিন্তু এই উপত্যকায় ভালোই গরম। আমরা সবাই প্রবল পানি তৃষ্ণায় শুকনো কাঠ হয়ে গেলাম। হঠাৎ আমাদের সামনের ভারতীয় ভদ্রলোকটি আর লিয়্যাং ক্যাং সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘পানি পানি সামনে হ্রদ আছে, হ্রদ”। আমি ভয় পাচ্ছিলাম মরিচিকা ভেবে। কিন্তু আমরা যতটা দ্রুত পারি দ্রুত হেটে ওখানে গিয়ে দেখলাম, না মরিচিকা না, আবার হ্রদও না। কারন যে জলাশয়টা দেখচ্ছি তা খুব বেশি গভীর নয়। আমার কোমড় পর্যন্ত হবে। আর আকারে বাংলাদেশের কোন ডোবার চেয়ে খুব বেশি বড় হবে না। এই পানি পান করা ঠিক হবে কিনা আমরা সবাই আলাপ করছি। একেই বদ্ধ পানি। উপর থেকে কাছে পিঠেই হায়ানারা বাস করে। অন্য প্রানী থাকাও বিচিত্র কিছু না। আমার পেছনের ককেশিয়ান লোকটি বলল, আমাদের বেঁচে থাকাটা যেমন অনিশ্চিত, আমাদের মৃত্যুটাও তেমনি অনিশ্চিত।“ এই বলেই সে পানিতে নেমে পড়ল। আমার সামনের কলকাতার ছেলেটি আমাকে বলল, দাদা আমার মনে হয় পানি ভালোই হবে, কেমন টলমল করছে, দেখুন!” এই বলে সেও নেমে গেল। এবং নেমেই সে কি আনন্দ। আমি বুঝতে পারলাম না এই পানির উৎস্যটা আসলে কি? এটা কি কোনো শুকিয়ে যাওয়া লাভা মুখ, যাতে বৃষ্টির পানি জমে রয়েছে। নাকি মাটির নিচে এর কোনো উৎস্য রয়েছে? যাইহোক, বদ্ধ পানি বিশুদ্ধ হওয়ার কথা না। কিন্তু কেই বা এইসবের পরোয়া করে, আমার জানা মতে প্রায় দুই দিন আমরা কেউ পানি পান করিনি। সর্বাঙ্গে লেগে আছে রাজ্যের ময়লা। দেখলাম একে একে সবাই লাফ দিচ্ছে। আমিও দিলাম একটা লাফ। আহ কি শান্তি। পানি খুব ঠাণ্ডা না হলেও খুব একটা গরম নয়। আর পানিটা মোটা মুটি স্বচ্ছ। তল দেখা যায়। আমরা সবাই দীর্ঘখন ধরে গোসল করে নিলাম। এরপর ডোবাটার অপর প্রান্ত থেকে পানি ও খেয়ে নিলাম। আমরা ভুল করেছি, পানিতে নামার আগে পানি পান করা লাগত। এখন ঐ পানিতে গোসল করে শরীরের সব ময়লা ধুয়ে তার পর পানি খেতে হল। পানিতো খেতেই হত। এই জন্যই অপর প্রান্ত থেকে পানি পান করা। পেট ভরেই পানি খেলাম কোনো বাছ বিচার করলাম না। যা হবে দেখা যাবে। কিন্তু একটা সমস্যা অবশ্য হল। আমাদের মুখের ভেতর ফুলের পলিনের মত মসৃণ পিচ্ছিল আশ মত কিছু একটা অনুভব করতে লাগলাম। জিহ্বায় একটু ইরিটেশন হচ্ছে বটে। চোখ ছানা বড়া হয়ে গেল। ওইগুলা মনে হয়ে জিহ্বার উপর নড়চ্ছে। গা ঘিন ঘিন করে উঠল। আমি সাথে সাথে আমার হাতের উপর থুথু ফেললাম। দেখলাম ওইগুলা হালকা লালচে বর্ণের, কিন্তু বেশির ভাগই স্বচ্ছ দেখতে। এই জন্যই ওদেরকে আমরা পানি তে খালি চোখে দেখতে পাই নি। তবে ওইগুলা যখন একসাথে দল বদ্ধ হয়, তখন ওদের রং লালচে বর্ণ ধারণ করে। এবং ওরা নড়চ্ছে! খুব ধীরে হলেও ওরা নড়চ্ছে! সবাই ওয়াক থু থু করতে থাকল। আমার গা গুলিয়ে উঠল। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। বমি করে ফেললাম। শুধু পানি নির্গত হল। আর কিছু তো খাইনি এই দুই দিনে যে অন্য কোনো কিছু বের হবে। বমি থেমে গেলে আমার কাপড় চোপড় সব এক টানে খুলে ফেললাম। তারপর মাটিতে ধূলা আর বালির ভেতর গড়া গড়ি দিতে লাগলাম এই আশায় যে এতে অন্তত পোকা গুলো শরীর থেকে ঝরে যাবে। আমার দেখা দেখি সবাই একই কাজ করতে লাগল। কিছুক্ষন পর আমরা ধাতস্ত হলে নিজেদের শরীর থেকে ধূলা বালি যতটা সম্ভব ঝেড়ে ফেলে নিজেদের জামাকাপড় পরে নিলাম। এরপর আবার হাটা শুরু করলাম। গলা এর মধেই শুকিয়ে গেছে। যাবেই বা না কেন। আমি যে পরিমাণ পানি খেয়েছি সবতো বমি করেই বের করে দিয়েছি।
এরপর আমারা হাটছি। পায়ে সেঁকল পরা কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ শুধু হেটেই চলেছে। লক্ষ্য ঐ দুরের তৃণভূমি। কারণ ওখানে হয়ত খাদ্য ও পানি রয়েছে। আমাদের পরিচয় এখনো অজানা। কিভাবে বা কবে থেকে প্রথম হাটা শুরু করলাম জানি না, আর কত দুর বা কত দিন হাটতে হবে তাও জানি না। কেন হাটচ্ছি তাও জানি না। কে হাটাচ্ছে তাও জানি না। ভারতীয় ভদ্রলোক থেমে দাড়ালেন, আমরাও থামলাম। সে পেছনে ঘুরে আমাদেরকে বললেন, “শোন আমার খুব খারাপ লাগচ্ছে।“ মনে হয় তার ভাঙ্গা পাঁজর ফুসফুস বা অন্য কোনো ইন্টারনাল অর্গানে ঢুকে ছিদ্র করে ফেলেছে। এতক্ষণ মনে হয় তার ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়েছে। এখন তার পক্ষে আর সামনে আগানো সম্ভব না। তার যাত্রা এখানেই শেষ। সে আস্তে করে হাটু মুড়ে বসে পরল। আমরাও তার সাথে বসে পড়লাম। সে আস্তে আস্তে বলতে লাগল, “ঐ প্রাণীটা এখনো আমাদের পেছন ছাড়েনি। ঐ পাথরগুলোর আড়াল দিয়ে সে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের পিছু কোরছে। এরপর আঙ্গুল দিয়ে দূরে কিছু বিস্তীর্ণ সারি সারি পাথর দেখাল সে। তারপর আরো ধীরে, প্রায় ফিস ফিস করে বলল, “সুযোগ পেলেই আবার আক্রমণ করবে।“ তার পর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন, কিছুখন তার পিঠটা ওঠা নামা করল, তারপর সব বন্ধ হয়ে গেল। বুঝলাম তার শরীরে আর কোনো প্রান নেই। মঙ্গোলিয়ান লোকটি এখন আবার একটা পাথর নিয়ে লাশের কাছে চলে এল। আফ্রিকান লোকাটা তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, কি করছ?” মঙ্গোলিয়ান লোকটি বলল, “ও তো মারা গেছে। দেখলে না? ওকে এখন সেঁকল থেকে আলাদা করতে হবে। না হলে আমাদের গতি ধীর হয়ে যাবে। রাত হলেই ঐ জন্তু আরো সহজেই আক্রমণ করবে।“ আমাদের চারপাশেই ছোট বড় অনেক পাথর যত্র তত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এর ভেতর দিয়ে একটু দূরত্ব রক্ষা করে এগিয়ে চলা কোনো সমস্যাই না। আর শিকারি প্রানীর জন্য তা পানির মত সহজ। ভয়ে আমাদের বুক ছ্যাত করে উঠল কি হতে যাচ্ছে সেই আশঙ্কায়। এরপর আর কেউ আমরা মঙ্গোলিয়ান লোকটাকে বাঁধা দিলাম না। সে নিঃশব্দে তার কাজ করতে লাগল। খুব বেশি ক্ষন সেই দৃশ্য আমরা সহ্য করতে পারলাম না। অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এরপর আমরা অনেকটা পথ হেটেছি। সবাই এখন অনেক ক্লান্ত। আমরা আজকের মত যাত্রা ইস্থগিত করলাম কয়েকটা বড় বড় পাথর খুজে পেয়ে। দুটি ডিম্বাকৃতির বিশাল পাথর, একটা শোয়ানো, আরেকটা বসানো। বসানো পাথরটার উপর আরেকটা চ্যাপ্টা ধরনের পাথর, অনেকটা মাশরুমের ছাতার মত করে বসানো আছে। সুন্দর আস্তানা, এর উপর কোনো চারপেয় জন্তুর ওঠার সাধ্য নেই। কারন এই পাথরগুলো বেয়ে একেবারে উপরে উঠতে আমাদেরই ভিষন বেগ পেতে হলো। ছোট ছোট পাথর দিয়ে সিড়ি বানিয়ে উপরে উঠলাম। এর পর সেই পাথরের উপর আমরা সবাই শরীর এলিয়ে দিলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি, দূরে বেশ দূরে এখনো দেখা যাই সেই বিস্তীর্ন তৃণভূমি। মনে হল এখনো সেই ততটাই পথ বাকি আছে, যতটা পথ ঠিক পাহাড়ের উপর থেকে দেখেছিলাম। হতাশায় আমার বুক ভরে গেল। আমার আফ্রিকান বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করল, ”তুমি কিছু টের পেয়েছে, কেউ আমাদেরকে ফলো করছে কি না?” “কৈ নাতো, তুমি টের পেয়েছ?”। ও বলল, “নাহ, তবে তুমি আজ যখন অজ্ঞান হয়ে ছিলে তখনকার ঘটনা। আমরা পরে ঐ ভারতীয় লোকটিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ঐ ভাবে তার হাত ছুটে গেল কিভাবে। আমরা তো সবাই নেমেই গিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ওর হাত মনে হয় বেশি ঘেমে গিয়েছিল, তাই খাজ ধরে রাখতে পারেনি, পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঘটনা মোটেই তা নয়। সে যা বলেছিল এখন আমি তা বিশ্বাস করি।“ সে কি বলেছিল?” সে বলেছিল, “তোমরা যখন পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় নেমে পড়েছ, তখন ও হঠাৎ উপুরের দিকে তাকিয়ে দেখে আমরা যে সুরুঙ্গ দিয়ে বের হয়েছিলাম, ঠিক সেই সুরঙ্গ মুখে ঐ প্রানীটা তার বিশাল কুৎসিত মাথা বের করে আমাদের দিকে দেখছিল। ঐ বীভৎস জিনিস দেখেই আতঙ্কে ওর ব্যালেন্স হারিয়ে যায়। এবং আমরা সবাই পড়ে যায়।“ এর পর ও একটু থেমে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমিকি ওর কথা বিশ্বাস কর?” আমি বললাম, “ অবিশ্বাস করারর কিছু নেই, এমনটা হতেই পারে। তবে একটা চারপেয়ে প্রাণী, অত ওজনের, ত্রিশ চল্লিশ ফুট উচ্চতা বেয়ে নামবে কিভাবে তা আমার জানা নেই। হয়ত নিচে নামার অন্য কোন রাস্তা আছে”।
এখন গভীর রাত। আমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। পাহারাই ছিল চিনা লিয়্যাং ক্যাং । তবে মনে হয় সেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ওর চিৎকারেই আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ওর ভয়ার্ত চিৎকার। ও বলল, “নিচে দেখ, নিচে দেখ।“ নিচে দেখলাম, এই প্রথম ঐ জন্তুটা নিজের চোখে দেখলাম। কি যে বিশাল আকৃতির ঐ প্রানীটা। একটা যেকোন বাঘ এর আকৃতি প্রায় আট ফুটের মত হয়। একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার দৈর্ঘ্যে প্রস্থে আরো বিশাল হয়। কিন্তু এ তো বাঘ নয়। আকার আকৃতিতে যে কোন বাঘের প্রায় দ্বিগুণ হবে। আর হ্যা, ওর হা মুখটা এত বড় যে আমাদের যে কারো মাথাই আনায়াসে গিলে ফেলতে পারবে। ঐ জন্তুটা পাথরের এক ধার থেকে আরেক ধারে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে আর উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু সফল হচ্ছে না, আবার হালও ছাড়চ্ছে না। কি সেই ভয়ানক গর্জন আর ব্যার্থতার আস্ফালন! উপরে উঠতে পারছে না বলে জন্তুটি আরো বেশি গজরাচ্ছে। বার বার সে নিচ থেকে পাথরের ছাতার উপরে লাফ দিচ্ছে, আর পোড়ে যাচ্ছে। রাগে গজরাচ্ছে। তারপর আবার লাফ দিচ্ছে। এই হয়ত আমদের কারো পায়ে মনে হয় তার বিশাল থাবা বসিয়ে টেনে নিল আরকি! তাহলে তো সেঁকলে বাঁধা আমরা সবাই একসাথে নিচে পড়ে যাব। প্রানীটার ধাক্কায় আমাদের উপরে ওঠার হালকা পাথর দিয়ে বানানো সিড়িটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। কিন্তু সেটা নিয়ে আফসোস করার সময় পেলাম না। আমার পেছনে যে ছিল সে আমার বা পাশে বসেছিল, এমনিই লম্বা মানুষ, তারপর মনে হয় তার পা কিছুটা নিচে ঝুলে গিয়েছিল, সে হয়ত টেরও পাইনি। জন্তুটি তার পা ধরে তাকে অনেক খানি নিচে টেনে নিয়ে গেল। সেইসাথে আমিও হুরমুড় করে নিচে চলে গেলাম। সবাই আমার হাত উপর থেকে টেনে ধরল। কিন্তু লাভ হল না । জন্তুটি এখন ককেশিয়ান ঐ লোকটির পা থেকে তার থাবার নখ বের করে সজরে কামড় দিল। মট করে চোড়ুই পাখির পায়ের মত তার পা’টা দুভাগ হয়ে গেল। আর ঐ হ্যাচকা টানে উপর থেকে সবাই এবার হুড়মড় করে নিচে পড়ে গেলাম। ককেসিয়ান লোকটির দুই পা তখন তার পায়ের পাতা থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়ে গেছে। আমি তার হাত চেপে ধরে আছি, মনের কোন অবচেতনে, যাদের সাথে সেঁকলের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম, তাদেরকে মনের বন্ধন থেকে কিছুতেই ছাড়তে পারছিলাম না। আমার আফ্রিকান বন্ধুটি তখন আমার পেছন থেকে এসে টেনে ধরেছে, চিৎকার করে বলছে, “রিফাত ছেড়ে দাও, ওকে তুমি আর বাচাতে পারবে না।“ ততখনে তার কোমোড় পর্যন্ত ঐ জন্তু চিবিয়ে ফেলেছে। তার বড় বড় নাকের ছিদ্র দিয়ে গরম বায়ু আমার চোখে মুখে লাগতে লাগল। এমন সময় একটা কান্ড ঘটে গেল। মঙ্গোলিয়ান লোকটি একটি বড় সাইজের ধারালো পাথর তুলে নিয়ে আমার পাশ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ঐ জন্তুটির বিশাল বড় পুঞ্জাক্ষির মধ্যে সজোরে বসিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে জন্তুটির চোখ গলে ঘন তরল পদার্থ ছিটকে পড়ল আমার আর মঙ্গোলিয়ান লোকটার শরীরে। জন্তুটি তার শিকার ফেলে উলটো দিকে দৌড় দিল। সবাই তখন আনন্দের বিশাল এক উল্লাস ধ্বনি করে উঠল। আমি আর মঙ্গোলিয়ান লোকটা তখন ককেশিয়ান মানুষটার আধ খাওয়া লাশটা জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে আছি।
সকাল হয়েছে অনেক্ষন হল। এরপর রাতও হল। দুপরে গমগমে সূর্য যখন আকাশে প্রকট ছিল, শুধু সেই সময় আমরা সবাই ঘুমিয়ে নিলাম, ঐ সময় বাদে আমরা বাকি সময় হেটেই চলেছি। আমরা সেঁকলে আবদ্ধিত তেরজন মানুষ ছিলাম। সেখান থেকে কমতে কমতে এখ ছয় জনে দাঁড়িয়েছি। মানুষ কমেছে তাই সেঁকল আমাদের কাছে অনেক লম্বা হয়ে গেছে। আমরা এখন এই বাড়তি সেঁকল কাঁধে ও হাতে পেচিতে হাটছি। হাটতে হাটতে মাঝে মাঝে কখনো আমরা ক্যাকটাস থেকে পানি পান করি। কখনো আর্দ্র মাটি খুজে পেলে সেই মাটি থেকে পানি পান করি। এখানে প্রিকলি পিয়ার জাতিও একধরনের চ্যাপ্টা ক্যাকটাস খুব বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় কিন্ত ঐগুলা খেতে ভিসন কটু। সেই সাথে খেতে গেলে হাতে মুখে কাঁটা ফুটে নাকাল হতে হয়। এক ধরনের ক্যাকটাস পেলাম অ্যাপেল ক্যাকটাস। এক হারা গড়ণ এই ক্যাকটাসে এক ধরনের ডিম্বাকৃতির ফল ধরে। যা খেতে খানিকটা ড্রাগন ফ্রূইটের মত খেতে, ভেতরে আঠালো জেলির মত নরম স্বচ্ছ বস্তু, তার ভেতরে কালোজিরার মত অসংখ্য বীজ। খেতে খারাপ লাগে না। কিন্তু পানির বড়ই কষ্ট। আমাদের ইটালিয়ান বন্ধুটির পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে। সে আর হাটতে পারছে না। পচা অংশ থেকে খুব কটু গন্ধ বের হচ্ছে। অতি দ্রুত তার পায়ের পচা অংশটুকু কেটে না ফেললে তার পুরা শরীরে পচন ছড়িয়ে পড়বে। তখন আর তাকে বাঁচানো যাবে না। এই গুরু দায়িত্বটি আমাদের মঙ্গোলিয়ান বীর যোদ্ধাই হাতে তুলে নিল। সে একটা খুব চ্যাপ্টা পাথর বেছে নিয়ে ধার দিতে লাগল। যাতে পা কাটার সময় আমাদের ইটালীয়ান বন্ধুর কষ্ট কম হয়। এটা দেখে ইটালিয়ান বন্ধু ভয়ে গুটি সুটি মেরে গেল। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায় তার ভাল পাটিতো আমাদের সাথে এক সেঁকলে বাঁধা। তাকে আমরা সবাই চেপে ধরলাম। আমাদের নাম না জানা মঙ্গোলিয়ান বন্ধু এখন অপারেসন করবে। সে ইটালিয়ান লোকটিকে বলল, “তুমি মনে হয় আমাকে কসাই ভাব। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি আজ পর্যন্ত যা করেছি তা সবই নিজেকে বাচিয়ে রাখার জন্য করেছি। কিন্তু আমি আজ যা করছি তা তোমাকে বাচিয়ে রাখার জন্য।“ কিন্তু এ দৃশ্য আমি দেখার সাহস করতে পারলাম না, অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলাম। খালি ইতালিয়ান লোকটিকে চিৎকার করে তার সৃষ্টিকর্তাকে ডাক দিতে আর আমাদের সবাইকে গালাগাল দিতে শুনলাম। আর একটু পর ঐ লোকটি ব্যাথা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেল। দেখলাম তার পায়ের পচা অংশগুলো পাথুরে ছুরি দিয়ে যতখানি সম্ভব চেঁছে বাদ দিয়েছে মঙ্গোলিয়ান লোকটি । পরে কোথা থেকে মরুভুমির কিসব গাছগাছড়া এনে সেগুলো পাথরে পিষে তার কাটা পায়ে লাগিয়ে ভাল করে পেচিয়ে দিল। মনে মনে ভাবলাম লোকটি ডাক্তার বা বৈদ্য নাকি। হতেও পারে, কে জানে?
সেই তৃণভুমি, যার পানে আমরা ছয়জন ছুটেছি। জানি সেখানে যাওয়াই আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। আমাদের মুল উদ্দেশ্য নিজেদের বাড়িতে ফেরা। অথবা আমরা আদতেও বেচে আছি কিনা তা সঠিকভাবে জানা। এবং তারপর সদি এটা পরকাল না হয়ে থাকে তাহলে ঐযে, যা বললাম নিজেদের বাড়িতে ফেরা। তবে আরেকটি ব্যপারো আছে, ঐ জন্তুটির চোখের একটি দিক নিঃসন্দেহে কানা হয়ে গেছে। কারন সে আর নিজের অস্তিত্ব জানান না দিয়ে আমাদের পিছু করতে পারে না। হাটতে হাটতে দেখলাম দূরে রাস্তার কোন পাথর হয়তো আচমকাই খুব জোরে নোড়ে গেল। হুট করে সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম বিশাল দেহি সমগ্র দেহে লাল রোয়া ওঠা রাক্ষসটিকে। আমরা ওটাকে দেখতে পেরেছি বলে ওটা ভোঁ দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়। ও সুস্থ সবল থাকা অবস্থায়ও দিনের আলোকে আমাদের আক্রোমণ করার সাহস পেত না। এখন আরও সাহস পায় না। আশ্চর্য হলাম, প্রানীটি মনে হয় কিছু না খেতে পেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে আগের তুলনায়।
আমরা এখন ঐ সবুজ বনানীর অনেক কাছে চলে এসেছি, আমাদের পায়ের তলে এখন সবুজ ঘাসপালা পাচ্ছি। এত দিন পর ঐ রুক্ষ পাথুরে জমিন মাড়িয়ে মাড়িয়ে এই নরম সোদা মাটি আর ঘাস মাড়িয়ে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। মনে হল আমরা গ্রাম বাংলায় চলে এসেছি। হঠাৎ যেন চমকে উঠলাম, “গ্রাম বাংলা” কী? এই গ্রাম বাংলার সাথে নিশ্চয় আমার অনেক প্রানের সম্পর্ক আছে! নাহলে আমার হৃদয়ে এত আবেগ জেগে উঠল কেন? আমি বাংলাদেশি! কোনো সন্দেহ নেই, আমি বাংলাদেশি! সবাই পেছন ফিরে তাকাল। কারন আমার শেষের কথাগুলো কিছুটা জোরে বলে ফেলেছিলাম। আমার সামনের ভারতীয় ছেলেটি খুশিতে বলে উঠল, “দাদা বলেছিলাম না আপনি আমাদের মতই দেখতে। আমি জানতুম তখন থেকেই। এই বার মনে পড়েচে।“ যেই স্থানে আসার জন্য আমরা এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি পায়ে আবদ্ধ সেঁকল পরে। আমরা আজ সেই তৃণভুমিতে। চারিদিকে বিভিন্ন পাখপাখালি আর ঝি ঝি পোকার শব্দ শুনতে পারছি। নারিকেল গাছের মত কিছু গাছ চোখে পড়ল। দেখলাম ডাবের মত কি যেন ঝুলে আছে তাতে। সেদিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমার চোখের চাহনি দেখে আফ্রিকান বন্ধু বুঝতে পেরে বলল, “মনে হয় একজাতীয় বন্য পাম গাছ।“ আমরা আরো কিছুটা দুর এগিয়ে গেলাম। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। নাম না জানা কত প্রকার গাছে যে ভরপুর তার ইয়ত্তা নেই। বেশির ভাগ গাছই আমি চিনতে পারলাম না । আফ্রিকান বন্ধু দুএকটা গাছ চিন্তে পেরেছে। বুঝলাম আমার এই আফ্রিকান বন্ধুটির স্মৃতি ফিরে আসতে শুরু করেছে। আরো একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে পানির স্রোতের একটা শব্দ শুনতে পেলাম। খুব মধুর শব্দ, প্রবল স্রোতের নয়। বরং হ্রদপ্রতিম সরল তরল সুধাময় পানির শব্দ। আমরা দাড়িয়ে আছি সরবরের মত এক বিশাল জলাশয়ের সামনে। টলটলে তার পানি। আহ! দেখেও যেন শান্তি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমারা আর কোথাও যাব না। আমাদের স্মৃতিশক্তি পুরোপুরি না আসা পর্যন্ত আমরা এখানেই থাকব। ফলাহার করব, দীঘির ঠাণ্ডা পানি পান করব, আর আমাদের পায়ের সেঁকলগুলো কিভাবে ভাঙ্গা যায় সেই চেষ্টা করব। আমরা এবার আর ভুল করলাম না দীঘির পানিতে আমাদের রুক্ষু ময়লা হাত ডুবিয়ে আজলা ভরে জল তুলে নিলাম। আহ! কি সুন্দর টলটলে পানি! কিন্ত একি! তাতে যেন গলা ভিজচ্ছে না। আরও কয়েকবার আমরা চেষ্টা করলাম, হাত ভেজে, চোখে মুখে পানি দিলে তাও ভেজে, কিন্তু গলা ভেজে না কেনো! এই দুরাবস্থা শুধু আমার একার না। দেখলাম সবাই হাহাকার করছে। জাপানিজ লোকটি যার একটা হাত ভাঙ্গা ছিল, সে এবার দীঘির পানিতে লাফ দিল। সাথে সাথে সে ডুবে গেল। আমার সামনের ভারতীয় ছেলেটা চেচিয়ে উঠল,”ডুবে গেল, ডুবে গেল। লোকটিতো ডুবে গেল।“ আমার আফ্রিকান বন্ধুটি এবার পানিতে জোরে একটা লাফ দিল। আমারা সেঁকলে হ্যাচকা টান খেয়ে সবাই ঐ দীঘির মধ্যে পড়ে গেলাম। আমিতো সাঁতার জানি না, পানির কোনো তল খুজে পাচ্ছি না। পানির তল খোজা বৃথা চেষ্টা। ঠিক তখনি একটা দুঃস্বপ্নের মত মনে পড়ে গেল, আমি কি এর আগেও ডুবে গিয়েছিলাম? কোন সাগরে কিংবা নদীতে? কেউ একজন আমার হাত ধরে উপরে টেনে তুলল, এতক্ষণ পরে আমি ফুস্ফূস ভরে নিশ্বাস নিতে পারলাম। অবাক হয়ে গেলাম! কোথায় সে সবুজে ঘেরা বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, আর কোথায় সে হ্রদ! আমরা একটা চোরাবালির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। আমাদের আফ্রিকান বন্ধু আর কয়কজন নিজেদেরকে ইতোমধ্যেই উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছ। ওরাই সেঁকল ধরে আমাদেরকে টেনে উপরে তুলেছে। মাথার উপরে ঝাঝালো রোদ, মগজ যেন গলে বের হয়ে যাবে। এতক্ষন তাহলে যা দেখেছি, সব আসলে মায়া ছিল। মরিচিকা! পুরোটাই মরিচিকা! আমাদের সর্বশেষ মনোবল টুকুও ভেঙ্গে গেল।
এরপর আমরা আবার হাটতে থাকলাম। এভাবেই দিন যায়, রাত আসে। আমরা বিশ্রাম করি, আবার হাটতে থাকি। আমরা কজন এখনও বেচে আছি এই খেলায়। জানি না আর কতদিন। ইটালীয় লোকটি একটা পায়ে খুড়িয়ে খূড়িয়ে হাটে, আমার আফ্রিকান বন্ধুর কাঁধে ভর করে। এখনো দূরে, বহু দূরে দেখা যায় সেই বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। আমরা সেদিকেই চলেছি। হাটতে হাটতে আমরা মনে হয় অসুস্থ হয়ে পড়েছি। একদিন হাটতে হাটতে উহান থেকে আগত লিয়াং ক্যাং মাটিতে বসে পড়ল। তার গায়ে হাত দিয়ে বুঝলাম অনেক জর। কয়েকদিন ধরেই সে বলছিল, সে আর হাটতে পারছে না। তার শরীরে আর কুলাচ্ছে না। এর কোনো সমাধান আমাদের কাছে ছিল না। আমিওতো আর হাটতে পারছি না। এ যাত্রার শেষ কোথায়? সেদিনকার মত যাত্রা বিরতি দিয়ে আমরা একটা বড় পাথরের পাসে শুয়ে পোড়লাম। বলা বাহুল্য আমারা এখন আর ঘুমানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা খুজি না। যেখানেই রাত সেখানই কাত। আমরা সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তখন মনে হয় ভোর রাত। ঠিক সেসময় ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। একটি শব্দ পেলাম। চূর্ণ হয়ে যাওয়ার শব্দ। ধরমড়িয়ে আমরা সবাই উঠে পড়লাম। দেখলাম মঙ্গোলিয়ান লোকটি তার আগের জাইগায় শুয়ে আছে, শুধু তার মাথার জায়গায় একটি পাথর। পাথরটি তার মাথা চ্যাপ্টা করে মাথার যায়গায় বসে গেছে। এবং তার মাথার পাশে বসে আছে ইটালিয়ান ঐ ভদ্রলোক। কাপা কাঁপা গলায় বলল সে, “আমাকে , , , আমাকে পঙ্গু করে দেয়ার শাস্তি।“ আমরা তখনো ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে আছি। কি করব ঠিক বুঝতে পারচ্ছি না। ইটালিয়ান লোকটি তখন আবার বলল, “ওকে সেঁকল থেকে মুক্ত করতে হবে”। এই বলে সে মঙ্গলিয়ান লোকটিকে সেঁকল থেকে ছাড়ানোর ব্যাবস্থা করতে লাগল। পাথর দিয়ে আঘাত করে করে তার পা ভেঙ্গে সেঁকল থেকে আলাদা করল। বাকি রাত আমরা কেউ আর ঘুমালাম না। কেউ কারো সাথে কথাও বললাম না। সকাল হলে আমরা তৃনভূমির দিকে আবার যাত্রা শুরু করলাম। আমার আফ্রিকান বন্ধুটি ইটালিয়ান লোকটিকে হাটার জন্য তার কাঁধ আর ব্যাবহার করতে দিল না। ইটালিয়ান লোকটাকে দেখলাম একটা মুরিঙ্গা অর্থাৎ সজনের ডাল কুড়িয়ে নিয়ে হাটার কাজ চালাতে লাগল। খানিকটা দুরে যাওয়ার পর পেছনে তাকিয়ে দেখলাম সেই অতিকায় প্রাণীটা মঙ্গোলিয়ান লোকটির মৃতদেহ খুবলে খুবলে খাচ্ছে। তার খাওয়া শেষ হওয়ার প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে একদল হায়ানার দল। অনেক দুর থেকেও আমি ওদের সম্মিলিত হাশির ধ্বনি শুনতে পেলাম।
তবুও থেমে থাকা যায় না। দূরে এখনো হাতছানি দিচ্ছে ঐ সবুজ তৃণভূমি। ওখানে গেলেই মনে হয় আমাদের যাত্রা পরিণতি পাবে। ওখানে গেলেই মনে হয় আমাদের সব কষ্ট, সব ভোগান্তির আবসান হবে। কিন্তু সেই তৃণভূমি যেতে যে এখনো বেশ খানিকটা পথ বাকি। আমরা আর একদিন হাটতে পেরেছিলাম। লিয়াং-এর অবস্থা এখন খুব খারাপ। তার নিঃশ্বাসের কষ্ট আরো বেড়েছে। তার সাথে শুরু হয়েছে শুকনো কাশি। এদিকে জাপানিজ লোকটির মনে হয় পেট নেমেছে। সেঁকলে বাঁধা বলে আমাদের সামনে রেখেই তার ঐ কাজটি সারতে হচ্ছে। সে যে কি বাজে অবস্থা তা বলে বোঝানো যাবে না। একবেলাতেই তার অবস্থা আরো খারাপের দিকে চলে গেল। সে রাস্তার মধ্যেই কাটা গাছের মত পড়ে গেল। সামনে এগিয়ে যাওয়ার আর কোনো উপায় থাকল না। আমাদের পা সেঁকলে বাঁধা। এদেরকে এখানে রেখে অন্য কোথাও আশ্রয় খুজতে যাওয়ার উপায়ও নেই। অগত্যা কাছে পিঠে একটা বড় পাথর দেখতে পেয়ে, তার ছায়াই আমারা কয়েক জন শুয়ে পড়লাম। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না লিয়াং–এর কাশির তোড়ে। সেই সাথে জাপানিজ ভাইটির ঐ দুরবস্থা। সারারাত চলল তার এই ভোগান্তি। ভোর রাতের দিকে মনে হয় ঘুমের একটু ঝুল এসেছিল। হঠাৎ আফ্রিকান বন্ধুর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ও বলল, “দেখ, ওরা দুই জন নেই”। তাকিয়ে দেখলাম আমরা ছয় জন না, বরং চার জন শুয়ে আছি। লিয়াং ক্যাং আর ঐ ইটালিয়ান লোকটি নেই। তারা বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে! তাদের পায়ের শূন্য বেড়ি আর সেঁকল মাটিতে পড়ে আছে। আফ্রিকান বন্ধু বলল, “ওরা কোথায় গেল?” আমি বললাম, “ওরা চলে গেছে বাকিদের মত”। “কিন্তু কোথায়?” “জানি না, যেখানে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে।“
পরদিন দুপুরে ঘুম ভাঙল। শরীরে একফোটা শক্তি নেই। কিছু খাওয়া দরকার। দুই দিন ধরে না খেয়ে আছি। দূরে কয়েকটা মুরিঙ্গা গাছ দেখলাম। যাক, ঐ গাছের পাতা খেয়েও পেট ভরানো সম্ভব। আর কিছু ক্যাকটাসও দেখতে পাচ্ছি। এদের কোনোটা থেকে হয়তো পানিও পেয়ে যাব। আফ্রিকান বন্ধু এখনো ঘুমাচ্ছে। ভারতীয় ছেলেটা জেগে গেছে এবং গভীর মনোযোগ দিয়ে জাপানিজ লোকটার উপর ঝুকে কি যেন দেখছে। আমি বললাম, কি দেখছো”? ও উত্তর দিল, “দেখ না এই জাপানিজ দা নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। একি, উনি তো মারা গেছেন!”
জাপানিজ লোকটাকে সেঁকল থেকে মুক্ত করা হয়েছে। আমরা তিন জন এখন হেটে হেটে সেই মুরিঙ্গা গাছ গুলোর কাছে এলাম। হাত দিয়ে টেনে টেনে পাতাগুলো টপাটপ মুখে পুরতে থাকলাম। হাইরে খিদে! ভারতীয় বন্ধুটি বলল, “আমার স্ত্রীর সজনে ডাটা অনেক প্রিয় ছিল। গরম কালে এই বস্তু দিয়ে সে মাঝে মাঝেই ডাল রান্না করত, জান। আমার ভারী বিরক্ত লাগত। এই জিনিস আমি কেন জানি সহ্যই করতে পারতাম না। খালি বকা দিতাম। আর দেখ নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, এখন ঐ সজনে গাছের পাতা খেয়েই পেট ভরাতে হচ্ছে।“ আমার আফ্রিকান বন্ধুটি একটা ক্যাকটাস থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করচ্ছিল। আমাদের দিকেও বাড়িয়ে দিল পানি পান করার জন্য। আমরা তিনজন পেট ভরে মুরিঙ্গা পাতা আর ক্যাকটাসের পানি পান করে ঐ মুরিঙ্গা গাছের তলায় শুয়ে পড়লাম। আমি আমার আফ্রিকান বন্ধুকে বললাম, – “জানো সেদিন চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার সময় আমার মনে হচ্ছিল আমি এর আগে হয়ত কোন নদী বা সাগরে ডুবে যাচ্ছিলাম।“
সে বলল, – “তারপর”।
–“না, আমি এটা নিয়ে ভাবচ্ছিলাম। আসলে আমরা আমদের এই জীবন যুদ্ধের লড়াইয়ে এতটাই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি যে সব থেকে গুরুতবপূর্ণ বিষয়টাই ভুলে গেছি।“
– “সেইটা কি”।
– “সেইটা হলো ঐ তৃণভূমি আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ন কেন? মানে ঐখানে যে আমাদের পৌছাতেই হবে তা কেন?”
– “কারণ ঐখানে গেলে আমারা খাবার পাব, পানি পাব, ছায়া পাব। টিকে থাকার জন্য যা এখন অত্যন্ত আবশ্যক।“
– “তা ঠিক। কিন্তু পাহাড়ের উপর থেকে যখন আমরা তৃনভূমিটা আবিষ্কার করি তখন মনে হয়েছিল ঐখানে পৌছাতে সর্বচ্চো একদিন লাগতে পারে। অথচ দেখ, আমরা এত দিন ধরে হাটচ্ছি। তাও পৌছাতে পারি নি। আর ঐ জন্তুটা আমাদের আগে থেকে এইখানে বসবাস করে, তোমার কি মনে হয় না ওর এত দিনে ঐ তৃনভুমিতেই থাকার কথা ছিল“।
– “হ্যা। তাতে এইখানে ও যে পরিমাণ শিকার পাচ্ছে, ঐখানে আরও বেশি পরিমাণ শিকার পেত”।
– “কিন্তু তাহলে ও এইখানে কি করচ্ছে?
-“কি করছে?”
– “আমার কি মনে হয় জান। আমরা ভয় করচ্ছিলাম যাতে আমরা কোন মরিচিকায় না পড়ি। কিন্ত আসলে আমরা মরিচিকার পেছনেই হাঁটছি এতদিন ধরে।
– “তুমি কি বলতে চাচ্ছ, ঐ তৃণভূমি ঐখানে নেয়?”
– “হ্যা”। ও একটু অবিশ্বাসের সাথে তাকাল আমার দিকে। আমি বললাম, “আমাদের স্মৃতিশক্তি নেই কেন, আমাদের পায়ে সেঁকল পরানো কেন, আমরা এখানে এলাম কিভাবে, এতগুলো প্রস্নের উত্তর না জেনেই আমরা ভেড়ার পালের মত লাইন ধরে হেটে চলেছি। আর ঐ জন্তুটা নেকড়ে বাঘের মত আমাদের একজন একজন করে শিকার করে যাচ্ছে“। আমি আবার বললাম, “তোমার কি মনে আছে আরুশ আরনাভের কথা। ঐ শ্রিলঙ্কান ছেলেটা যে আমার সামনে ছিল”?
– “হ্যা”। ও অদৃশ্য হওয়ার আগে বলেছিল ওর তখন ক্লাসে থাকার কথা ছিল। তাই না”?
– “চিন্তা কর বন্ধু, চিন্তা কর। ওই ককেশিয়ান লোকটার গাড়িতে এক্সিডেন্ট করার কথা ছিল, আর আমার হয়ত পানিতে ডুবে মরার কথা ছিল”।
– “হ্যা”।
–“কিন্তু তা না ঘোটে এই ঘটনা কেন ঘোটলো”?
– “কেন”?
– “কারণ আমরা তা চাইনি।“
– “তাহলে কি আমারা এইটা চেয়েছি যে আমরা মরুভুমির মধ্যে থাকি, আর আমাদের পায়ে শেকল পরানো থাকুক”?
– “না, আমরা তাও চাইনি”।
– “তাহলে আমরা এইখানে কেন”?
– That’s a very good question my friend. What do you think?